বিশাল বড় হলঘর। একদিকে কারুকাজ করা কয়েক প্রস্ত সোফা, আরেক দিকে মস্ত এক ডায়নিং টেবিল, এছাড়াও নানা আধুনিক আসবাব পত্রে ঠাসা। চারদিকে সাজানো রয়েছে নানা রকমের উৎকৃষ্ট শিল্পকলার সম্ভার। সিঁড়ির পাশ দিয়েই প্রশস্ত একটা জায়গা আছে। সেখানেই দেয়ালে হাসিমুখ রূপবতী নারীর বিশাল একটা ছবি। সেই ছবিটাই চৈতীর অগ্রজা বোন দৈবীর।
প্রলয়ের সঙ্গে দৈবীর দেখেশুনে সামাজিক ভাবেই বিয়ে হয়েছিল। প্রলয় তখন একা। তার পিতৃদেব ও মা কেউই তখন আর জীবিত নেই। সাবিত্রী মাসিই যেটুকু দেখাশোনা করেন। সাবিত্রী মাসিই বার বার তাগাদা দিতেন, কর্তাবাবা আর কতদিন এভাবে একা থাকবে? বয়স তো পেরিয়ে যাচ্ছে, এবার বিয়েটা করে নাও। তোমার বাবা-মা বেঁচে থাকলে তো ওনারাই খোঁজখবর করতে পারতেন। উপায় তো নেই, তোমার বিয়ের কনে তোমাকেই খুঁজে নিতে হবে। আর যদি কেউ আছে তোমার, কাউকে যদি ভালোবেসে থাকো তাহলে তো কথাই নেই।
প্রলয় রইরই করে উঠেছিলেন, না না মাসি আমার সেরকম কেউ নেই। কাউকে যে ভালোবাসব সেরকম তো সময়ই নেই আমার।…তোমার যখন আমার বিয়ে নিয়ে এত ভাবনা, তুমিও তো খোঁজখবর নিতে পারো।
‘আমার খোঁজে তোমার পছন্দ হবে?’ অবাক হয়ে বললেন সাবিত্রী, কোথায় তুমি নামি ব্যবসায়ী সুজন দেবের ছেলে! অর্থবান লোক তোমরা। আমার পছন্দে তোমার মন ভরবে?
হেসে দিয়েছিলেন প্রলয়, তুমি একবার কোনও একটা খোঁজ দিয়েই দেখো না আমাকে? আমাকে যে ধনীর মেয়েকেই বিয়ে করতে হবে, এমন কি কথা!
প্রলয়ের কথা শুনে সাবিত্রী ভ্রু কুঁচকে কিছু যেন মনেমনে ভাবলেন। তারপর হঠাৎ উৎফুল্ল হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি হারাধন কুণ্ডুকে চেনো, সার কোম্পানির ডিলার?
‘কোন হারাধন কুণ্ড? বিধান মার্কেটের হারাধন কুণ্ডুর কথা বলছ?
‘হাঁ, ওই হারাধন কুণ্ডু। ওনার দুটো মেয়ে আছে। বড়মেয়েটি তো হারাধনের লক্ষ্মী!
‘তুমি কি করে চেনো ওদের?
‘তোমাদের এখানে আসার আগে তো আমি ওদের ওখানে কাজ করতাম। আমাকে এখনও ওরা খুব মানে, সম্মান করে।
‘হারাধন কুণ্ডু তো খুব বেশিদিন হয়নি এখানে এসেছেন! অবশ্য এটা আমার শোনা কথা। বাবার কাছে শুনেছিলাম।’ বললেন প্রলয়।
‘হ্যাঁ, ওরা তো বাংলাদেশের লোক! বেশিদিন বলতে, কুড়িপঁচিশ বছর তো হয়েই গেছে ওরা এখানে এসেছে।’ বলছিলেন সাবিত্রী মাসি, বাংলাদেশ যুদ্ধের পরে এদেশে চলে এসেছে। ওই হারাধন মাথায় টুকরিতে করে কলা নিয়ে ঘুরে ঘুরে বেচত! তারপর আস্তে আস্তে একটা রংয়ের দোকান খুলল। আর ওই সময়েই বড় মেয়ে দৈবীর জন্ম। কয়েক বছরের মধ্যে ফুলেফেঁপে উঠল হারাধন। রংয়ের সঙ্গে সঙ্গে বাড়িঘর তৈরির জিনিসপত্র রাখা শুরু করল, এখন তো আরও কত কিছু! কুড়ি-পঁচিশ বছর আগেও যে হারাধন মাথায় টুকুরিতে কলা নিয়ে ফেরি করে বেচত, সেই হারাধন এখন কোটি কোটি টাকার মালিক! রূপকথার গল্পের মতোই কিনা, তুমিই বলো?
সাবিত্রীর কথা শুনে হাসছিলেন প্রলয়।
‘একি! তুমি ওমন করে হাসছ কেন?’ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন সাবিত্রী।
‘মাসি, আমি হারাধনকে ভালো করে চিনি। হারাধন কি ছিলেন আর কি হয়েছেন আমরা জানি। ওনার এক ছেলে বর্তমান আমাদের প্লাইউড কোম্পানির বড় ডিলার।
‘বাঃ! তাহলে তো ভালোই হল। তুমি নিজেই প্রস্তাব নিয়ে যেতে পারো। আমি বলছি খুব ভালো মেয়ে। তোমার সংসারের জন্যে উপযুক্ত।
‘না মাসি, আমি যাব না, তুমিই প্রথম কথা বলবে। তুমিই আমার অভিভাবক।’ জোর দিয়ে বললেন প্রলয়।
সেই হারাধন কুণ্ডুর সঙ্গে ওনার বড় মেয়ের বিয়ের ব্যাপারে প্রলয়ের যোগযোগটা সাবিত্রীই করিয়ে দিয়েছিলেন। সামাজিক রীতি অনুযায়ী কনে দেখতে গিয়েছিলেন প্রলয়। দৈবীকে দেখে একবারেই পছন্দ হয়ে গেছিল তার। কপালের দিকে কোকড়ানো কোকড়ানো চুল। অথচ পেছনের দিকে সেই কোকড়ানো চুলই মসৃণ নেমে গেছে নিচের দিকে। চোখ দুটো তার অত টানা টানা নয়। কিন্তু দুই চোখের মধ্যেও যেন মিশে আছে সরল মিষ্টি হাসি। আর দেবীর মতোই যেন রূপবতী। সার্থক নাম দৈবী।
হিন্দু বাঙালি পরিবারের কৃষ্টি সংস্কৃতির ধারা অনুযায়ী বিয়ে সম্পন্ন হয়েছিল তাদের। প্রলয়ের দিক থেকে আড়ম্বর খুব একটা বেশি ছিল না। জৌলুস আড়ম্বর বেশি ছিল কুণ্ডুদের দিক থেকেই।
বিয়ের পরে দৈবীকে নিয়ে মধুচন্দ্রিমা যাপনের জন্যে প্রলয়ের সুইজারল্যান্ডের জুরিখে যাওয়ার খুব ইচ্ছে ছিল। দৈবী বাধ সাধল। ব্যস্ত হয়ে বলে উঠেছিল, না না! আমি সুইজারল্যান্ড যাব না! ওসব দেশে ঐআবার উল্লসিত হয়ে বললেন, বুঝেছি তোমার পাহাড় ভালো লাগছে না। পাহাড়ে যাওয়ার তোমার ইচ্ছে নেই। বেশ তো তাহলে আমরা মরিশাস যাচ্ছি হানিমুন করতে, দিস ইস ফাইনাল। আর কোনও কথা নয়। মরিশাসের সমুদ্র সৈকতে।
এরপর আর বাধা দেওয়ার মতো কোনও যুক্তি অথবা উপায়ও ছিল না দৈবীর। মেনে নিয়েছিল সে প্রলয়ের মরিশাসে হানিমুনে যাওয়ার বায়নাকে। তবুও মরিশাস অনেক নিশ্চিন্ত নিরাপদ। বিস্তীর্ণ সমুদ্র সৈকত বেষ্টিত সমতল দ্বীপ।
তখনও প্রলয় জানতেন না পাহাড়ে কেন যেতে চাইছে না দৈবী। পাহাড় নিয়ে কেন তার এত এলার্জি! প্রলয় জেনেছিলেন তো অনেকদিন পরে। ততদিনে দৈবী অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়েছিল।
পুব আকাশে সূর্যোদয় ঘটে গেছে বেশ কিছুক্ষণ আগেই। প্রিহান ঘুম থেকে উঠে তাদের বাড়ির পুবমুখী ঝুলবারান্দাটায় এসে দাঁড়াল। শরীর হাত-পা ঝাড়া দিয়ে হাই তুলছিল। জিমেও যাওয়া হচ্ছে না কয়দিন থেকে। কিরকম যেন একটা আলস্য পেয়ে বসছে তাকে। তাকিয়ে ছিলে সে সামনের ফুলের বাগানটার দিকে। নির্মল সুন্দর একটা সকাল। থোকা থোকা ফুল ফুটে আছে বাগানে। নানা প্রজাতির গোলাপ, ক্যামেলিয়া, গাঁদা আরও কত কি।
ঝুলুবারান্দার এই নিচ থেকে বেশ বড় একটা পুষ্প উদ্যান বাড়ির সদরগেট পর্যন্ত বিস্তৃত। প্রথম সূর্যোদয়ের গোলাপি আভা এসে পড়ছে সেই পুষ্প উদ্যানে। মৃদু মৃদু বাতাসও বইছে। বনমালীকাকা জল ছিটিয়ে দিচ্ছিলেন ফুল আর গুল্মগুলোতে।
এই সময় হাতে ডালি নিয়ে বাগানে ফুল তুলতে ব্যস্ত পায়ে এসে দাঁড়াল চম্পা। যেন বাগান থেকে ফুল তুলতে গিয়ে আজ তার দেরি হয়ে গেছে। তাড়াহুড়ো করে ফুল তুলছিল সে। পরিধানে হালকা সবুজ একটি পুরানো নাইটি। লঘু হয়ে গেছে যার বুনুন। মাথার চুল আগোছালো।
ওপারের প্রান্ত থেকে সূর্যের গোলাপি তীক্ষ্ম রশ্মি এসে পড়ছে তার গায়ে। লঘু
হয়ে পড়া বুনুরের স্বচ্ছ সেই নাইটির মধ্যে থেকে যেন কুমোরটুলির প্রতিমার মতো একটি অপরূপ গড়ন আচমকা উদ্ভাসিত হয়ে উঠল প্রিহানের চোখের সামনে। যেন চমকে উঠল প্রিহান। শিরশির করে উঠল শরীর। খোলা চুল পেছনে বিন্যস্ত। হাওয়ার বেগে চুল সামনে চলে আসছে। আবারও পেছনে সরিয়ে দিচ্ছে চম্পা।
কি যে সুন্দর লাগছে মেয়েটিকে! জাস্ট লাইক শিল্পীর গড়া একটা প্রতিমা! মনে মনে নিজের অজান্তেই বলে উঠল প্রিহান। সেদিন তার ঘরে কম্পিউটার টেবিল মোছার পর থেকে দেখছিল না সে দুদিন থেকে সেই মেয়েটিকে। তাকে ভুলেও গেছিল প্রায় সে, কি যেন নাম বলেছিল, হা চম্পা। এই মেয়েটি কি সেই চম্পা?
Write a comment ...