দেব বাড়ির তিনতলায় বিশাল ঠাকুরঘর। ঠাকুরঘরের পুরো দায়িত্ব সাবিত্রীর। বাড়ির কর্তা প্রলয় দেব ঠাকুরঘরে প্রবেশের আগে সাবিত্রীকে পূজা আহ্নিকের সমস্ত আয়োজন সেরে ফেলতে হয়। পুজোর বাসনকাসন ধোয়া, ঘর মোছা, বাগান থেকে ফুল তুলে নিয়ে আসা ইত্যাদি।
সাবিত্রী আজ অসুস্থ, তাই সেই কাজগুলো সারতে হচ্ছে চম্পাকে।
ঠাকুরঘরে একজন অচেনা মেয়েকে দেখে চমকে উঠলেন প্রলয়, এই মেয়ে তুই কে? তোকে তো চিনলাম না?
থতমত খেয়ে উঠে দাঁড়াল চম্পা। আরষ্টা হয়ে বলল, আজ্ঞে আমি আপনাদের বাড়ির নতুন কাজের মেয়ে চম্পা।
'ও তাই নাকি? তোকে এখানে কে পাঠিয়েছে? সাবিত্রী মাসি কোথায়?' জিজ্ঞেস করলেন প্রলয়।
'দিদার শরীরটা আজ ভালো নেই, জ্বর এসেছে। তাই আমায় বললেন ঠাকুরের বাসগুলো ধুয়ে ঘরটা পরিষ্কার করে দিতে।
'একি! সাবিত্রী মাসির শরীর ভালো না, আমায় তো কেউ বলেনি? আজকাল প্রায়ই ওর জ্বর আসছে! লক্ষণ তো ভালো নয়! ওকে ভালো একজন ডাক্তার দেখাতে হবে তো।
বলতে বলতে দোতালায় নেমে গেলেন প্রলয়। হাঁক দিয়ে ডাকছিলেন চৈতীকে, চৈতী.. চৈতী..
চৈতী সকালের জলখাবারের কথা বলে দিচ্ছিলেন কালিন্দীকে। প্রলয়ের হাঁক শুনে দৌড়ে এলেন, কী ব্যাপার, ওরকম করে চেঁচাচ্ছ কী জন্যে?
'সাবিত্রী মাসির শরীর খারাপ শুনলাম। আমার ঠাকুরঘরের কাজ কে করবে?
‘গতকাল থেকে ওনার পরিচিত একটি মেয়েকে এই বাড়ির কাজে নিয়েছি। ওই করে দেবে।’ বললেন চৈতী।
'হাঁ, ওকে তো দেখলাম পূজা ঘর মোছামুছি করছে। কিন্তু সাবিত্রী মাসির মতো ও কি পারবে?' সন্দিগ্ধ প্রলয়। আবার বললেন, আমার কখন কি দরকার ও কি জানে? আর সাবিত্রী মাসির প্রায়ই আজকাল শরীর খারাপ থাকছে, ভালো ডাক্তার দেখানোর ব্যবস্থা কেন করছ না?
'ভালো ডাক্তার দেখানো হচ্ছে কি হচ্ছে না, তুমি জানো? বাড়ি ঘরের খবরাখবর আজকাল তুমি কিছু রাখো? শুধু তো অফিস আর বাড়ি । আর মাঝে মাঝে ফ্যাক্টরিতে যাও, এইতো।
‘চৈতী, শেষে তুমিও আমাকে এই কথা বলছ? আমি কি কোনও দায়িত্ব পালন করছি না? এসব তাহলে আমি কাদের জন্যে করছি?’ অনুযোগের সুরে বললেন প্রলয়।
চৈতী প্রসঙ্গের মোড় ঘুরিয়ে বললেন, থাক হয়েছে, এসব কথা অনেকবার শুনেছি। তুমি ঠাকুরঘরে যাও। চম্পা খুব ভালো মেয়ে, তোমার কি দরকার, কি প্রয়োজন ভালো ভাবে বুঝিয়ে বলে দিও, ও ঠিক সামলে নেবে।
আর কথা না বাড়িয়ে প্রলয় সিঁড়ি বেয়ে আবারও চলে গেলেন তিনতলার পুজোর ঘরে। গিয়ে দেখলেন সুন্দর গুছিয়ে কাজ করছে মেয়েটি। মুখখানা ভারী মিষ্টি। আর যেন খুব চেনা চেনা মনে হয়। কোনও একটা মুখের সঙ্গে কোথাও যেন খুব মিল খুঁজে পাওয়া যায়! কিন্তু কোন সেই মুখটা! সেই দীপ্তির মতো অনেকটা কি? দীপ্তির কথা মনে হতেই যেন অজান্তে এই মেয়েটিকে দেখেও একটা মায়া লেগে যাচ্ছিল প্রলয়ের অন্তরে। প্রলয় জিজ্ঞেস করলেন, তোমাদের বাড়ি কোথায় মা?
বাড়ির বড়বাবুর মুখ থেকে এমন একটা আন্তরিক ডাক শুনে চমকে উঠল চম্পা। শ্রদ্ধায় আনত হয়ে জিজ্ঞেস করল, আমি তোমায় জেঠু বলে ডাকতে পারি?
‘ঠিক আছে, তোমার যদি তাতে ভালো লাগে তো ডেকো।’ বললেন প্রলয়।
‘জেঠু, আমাদের বাড়ি ওই রেলগেটের ওদিকে।
‘তোমার বাবা?
‘বাবা নেই। আমিই বাড়িতে একা, আর মা আছেন। আমার এক পিসি আছেন, ওই পিসির কাছেই থাকেন মা।
‘ভালো। তাহলে এবার আমি পুজোয় বসি?
‘হাঁ হাঁ বসুন।…আমি কি এবার তাহলে যাব, নাকি এখানে থাকব?
‘না না। তুমি যেতে পারো। আমি পারব এবার। করে নেব।’ বললেন প্রলয় ।
পুজোয় বসলেন প্রলয়। কিন্তু মনটা চম্পা নামের বাড়ির কাজের মেয়েটিকে দেখার পর থেকেই কেমন যেন খচখচ করেই যাচ্ছে। গোবিন্দের ধ্যানে মন বসাতেই পারছিলেন না। বার বার আজ কেনজানি মনে পড়ে যাচ্ছে দীপ্তির কথা। কত বছর তো হয়ে গেল তবুও যেন আজও ভুলতে পারেন না তিনি দীপ্তিকে। চৈতীকে বিবাহ করার আগে দীপ্তি খুব বেশিদিনের জন্যে ছিল না এখানে। সেই সল্প সময়ের মধ্যেও প্রলয় সত্যিই কি ভালবেসেছিলেন দীপ্তিকে। নাকি সেটা শধুই ছিল রূপের মোহ? শরীরের পিপাসা?
‘কি হল, পুজো হল তোমার? এত দেরি হচ্ছে কেন?’ চৈতী হাঁক দিচ্ছিলেন নিচের ডায়নিং হল থেকে।
যেন চমকে উঠলেন প্রলয়। আবারও চৈতীর গলা শোনা যাচ্ছিল, প্রিহান বসে আছে তোমার জন্য, তাড়াতাড়ি এসো।
সাড়া দিলেন প্রলয়, হ্যাঁ হ্যাঁ আসছি।
পুজো আজ যেন দেওয়াও হলো না ভালো করে। নেমে আসলেন তিনি তিন তলার পুজোর ঘর থেকে। এসে দেখলেন প্রিহান বসে আছে ডাইনিং টেবিলে। মোবাইল হাতে নিয়ে কিছু ঘাঁটাঘাঁটি করছে।
অন্যমনস্ক প্রলয় প্রতিদিন যে চেয়ারে বসেন সেটায় না আজ বসে পড়লেন অন্য একটা চেয়ারে।
'কি ব্যাপার তুমি আজ এখানে বসলে?' অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন চৈতী।
আচমকা মেজাজ করে উঠলেন প্রলয়, এখানে বসছি তো কি হলো? তাতে কী মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে গেল?
'বলছি, তুমি কখনও এখানে বসো না তো, তাই।
'অত কথা শুনতে আসিনি, খাবার দেবে তো দাও।
'কি হয়েছে তোমার? অত মেজাজ দেখাচ্ছ কি জন্য? আজকাল আমি কোন কথা বললেই তোমার রাগ হয়। কি দোষ করেছি আমি?' অভিমান উথলে উঠল চৈতীর গলায়।
মোবাইল থেকে মুখ সরিয়ে প্রিহান বলে উঠল, হায় কৃষ্ণ! ড্যাড তুমি আন্টির সঙ্গে এভাবে কথা বলছ কেন?
'বাব্বা! আজ দেখছি আন্টির জন্য তোর খুব দরদ উথলে উঠেছে! অন্যে সময় তো আন্টির কথাও শুনতে পারিস না!' বললেন প্রলয়।
কোনওরূপ প্রতিবাদ করল না প্রিহান। নীরবে খাওয়ায় মন দিয়ে দিল।
প্রলয় গম্ভীর মুখে প্রিহানকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার ফাইনালের রুটিন দিয়েছে?
'না, এখনও দেয়নি।' ব্যস ওইটুকু কথা বলেই প্রিহান আবার চুপ হয়ে গেল।
'আমাদের ফরেন সাপ্লাইয়ারের সঙ্গে আমি কথা বলে রেখেছি কিন্তু। যাতে স্টেটসের কোনও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তুমি এমবিএটা করতে পারো, সেই চেষ্টা উনি করছেন।
'কিন্তু ড্যাড আমি তো ভেবেছি যদি জেএনইউতে চান্স পাই, হিস্ট্রি নিয়ে পড়ব।
আচমকা যেন রুষ্ট হয়ে উঠলেন প্রলয়, কি বলছ তুমি এসব? ইতিহাস পড়ে তুমি করবেটা কী? সেই তো মুঘলদের ইতিহাস! যা স্কুলে পড়েছ, যেগুলো এখন কলেজে পড়ছ, সেগুলোই তো পড়বে।
'নো ড্যাড নো! নিউ এডুকেশন পলিসি এডপ্ট হয়েছে, অনেক কিছু পালটে যাচ্ছে। আগের মতো বাঁধাধরা কিছু নেই!
‘না না। আমার তাতে মত নেই। ইতিহাস পড়ে তোর ফিউচার কী? আমি চাই স্টেটস থেকে এমবিএ করে এসে আমাদের কোম্পানিতে জয়েন করো। আমার এই বিজনেস তবে কার জন্যে? তোদের জন্যেই তো! আজ পু যদি আমার কিছু অঘটন ঘটে যায় এই ব্যবসা কে সামলাবে? তোর ওপরে এইটুকু ভরসা কি আমি করতে পারি না?
চৈতী এতক্ষণ নীরব ছিলেন। আচমকা বলে উঠলেন, প্রিহান কি এখনও ছোট আছে, তোমার কোনও অভিমত ওর ওপর চাপিয়ে দেবে?
‘ইউ সাটআপ চৈতী! তোমাকে এসব ব্যাপারে মাথা ঘামাতে হবে না।’ আচমকা ক্রুদ্ধ হয়ে উঠলেন প্রলয়।
চৈতী হতভম্ব অপ্রস্তুত হয়ে পড়লেন। চোখ ছল ছল করে উঠল। বললেন, হাঁ এখন তো বলবেই, আমার মাথা ঘামাতে হবে না। খেয়া পার হয়ে গেছো তো, এখন পাটনি শালা!
বলে ক্ষণিকের জন্যে থামলেন চৈতী। আবার বলে উঠলেন, প্রিহান কি আমার কিছুই নয়? হাঁ, মায়ের দুধ আমি ওকে খাওয়াতে পারিনি। তাই বলে ওর ওপর আমার কি কোনও অধিকার নেই?
‘প্লিজ আন্টি ওসব কথা এখন থাক।’ বলল প্রিহান।
‘কেন থাকবে প্রিহান?’ ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন চৈতী, একদিন না একদিন তোমাকেও তো পুরোটা জানতে হবে।
কথা যেন শেষ হল না চৈতীর। প্রলয় দুঃখিত হয়ে বললেন, চৈতী প্লিজ! আমি তোমায় আঘাত করতে চাইনি। আমার ব্যবহারে যদি তুমি দুঃখ পেয়ে থাকো, আমায় ক্ষমা করো। আমি ক্ষমা চাইছি।
চৈতী আর কথা বাড়ালেন না।
প্রলয় প্রাতরাশ শেষ করে নিজের ঘরে গিয়ে প্রস্তুত হয়ে এসে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেলেন। প্রিহান ডায়নিং টেবিল ছেড়ে উঠে দোতলায় নিজের ঘরে চলে গেল। ডায়নিং টেবিল লাগোয়া চেয়ারে একা বসে রইলেন চৈতী।
Write a comment ...